ডেস্ক রিপোর্ট :
বরগুনার স্কুলশিক্ষক আব্দুল বাতেন (৬০) সচিবালয়ে ব্যাক্তিগত কাজে ঢাকায় এসেছিলেন। কাজ শেষে বাড়ি ফেরার আগে বসলেন সুপ্রিম কোর্ট সংলগ্ন মাজার মসজিদে ইফতার করতে। সঙ্গে যোগ দিলেন হোটেল বয় মো. আলিম, রিকশাচালক আব্দুস সাত্তার ও হকার মো. তমিজ। এর আগে তারা কেউ কাউকে চিনতেনও না। অথচ ইফতারের প্লেট সামনে নিয়ে মাগরিবের নামাজের আজান হতেই একসঙ্গে বসে একই পাত্রে শুরু করলেন ইফতার।
রাজধানীর হাইকোর্ট এলাকায় সুপ্রিম কোর্ট মাজার ও মসজিদ কমপ্লেক্সে রমজান মাসে প্রতি সন্ধ্যায় দেখা যায় সম্প্রীতির এমন নজির। সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান, শ্রেণি–পেশার ভেদাভেদ ভুলে এখানে প্রতিদিনই ইফতার করে থাকেন হাজারো মানুষ। মাহে রমজানে পুরো এক মাস ইফতারের সময় সুপ্রিম কোর্ট মাজারে ধনী-গরিবসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
একই পাত্রে একসঙ্গে চার থেকে পাঁচজন ইফতার খেয়ে থাকেন। প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার মানুষ একসঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট মাজার মসজিদে ইফতার করেন। রমজানের প্রতিদিন ইফতারের এই উদ্যোগ সুপ্রিম কোর্ট মাজারে এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের পাশেই একটি মাজার ও সঙ্গে রয়েছে মসজিদ। এটি সুপ্রিম কোর্ট মাজার মসজিদ হিসেবে পরিচিত। হজরত শাহ খাজা শরফুদ্দিন চিশতী (র.) ওরফে বাবা ওলি বাংলার মাজার এটি। যদিও আদালতে আগতরা এই গেটকে সুপ্রিম কোর্টের মাজারগেট বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। এই পরিচয়ে সমধিক পরিচিত সুপ্রিম কোর্টের এই গেট।
সুপ্রিম কোর্টের ওই মাজার মসজিদে পবিত্র রমজান মাসে প্রতিদিনই ইফতারের আয়োজন হয়ে থেকে। এতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কয়েক হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। মাজারের ভক্তদের অর্থায়নে সুপ্রিম কোর্ট মাজারের পক্ষ থেকে মানুষদেরকে ইফতার খাওয়ানো হয়।
সরেজমিন ইফতারের পূর্বমুহূর্তে মাজার ঘুরে দেখা যায়, সুপ্রিম কোর্ট মাজার মসজিদের ভেতরে প্রস্তুত করা হচ্ছে ইফতার। শরবত, মুড়ি, ছোলা, জিলাপি, বুন্দিয়া, কলা, ফলসহ কয়েক পদের খাবার। একই সঙ্গে রয়েছে খিচুড়ি ও তেহারি। মাঝারি আকারের প্রায় ৫০০টি প্লাস্টিকের পাত্রে ইফতার প্রস্তুত করা হচ্ছে। মাজারের একজন খাদেম জানান, প্রতিটি পাত্রে চারজন করে ইফতার করেন। এ ছাড়া তাদের জন্য পৃথকভাবে শরবত প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি থাকে তরমুজ, বাঙ্গি, আনারসসহ বিভিন্ন ফল। কোনো কোনো দিন থাকে খিচুড়ি, বিরিয়ানিসহ ভারী খাবারও।
বিকাল সাড়ে ৩টার পর থেকেই রোজাদাররা মসজিদে মাজারের দিকে আসতে শুরু করেন। আবার অনেক ভক্ত যারা মানত করেন তারা জোহর নামাজ আদায় করে দোয়া জিকিরে বসেন। সন্ধ্যায় ইফতারে শামিল হচ্ছেন চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, পুলিশ, রিকশা-ভ্যান চালক, দিনমজুর, ভিক্ষুক, পথচারী, নারী, বৃদ্ধ, শিশু, মসজিদের ইমাম ও খাদেমসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রতিদিন কমপক্ষে দুই হাজার রোজাদার এখানে ইফতার করেন।
তবে, বিশেষ করে সপ্তাহে দুই দিন প্রায় ছয় হাজারের মতো মানুষ ইফতার করেন বলে জানা গেছে। বৃহস্পতি ও শুক্রবার- এই দুইদিন বিশেষ আয়োজন থাকে, তাই মানুষও বেশি হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, রান্নার কাজে যারা থাকেন তারা মূলত সকাল থেকেই হাড়ি-পাতিল পরিষ্কার করে রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পাড়েন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও বাড়ে ব্যস্ততা। জোহর নামাজ শেষে ইফতার তৈরি শুরু করেন বাবুর্চি ও তার সহযোগীরা। পুরো মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়, বিছানো হয় বিশেষ কাগজ। আসর নামাজের পর বিছানো কাজগের দুই পাশে সারি সারি মানুষ মুখোমুখি বসে পড়েন।
সারিতে বসা রোজাদারদের সামনে প্রায় ৫০০ বড় বড় গামলায় সাজানো থাকে মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, খেজুর, জিলাপি, শরবত, তরমুজ ও আপেল। লাল রংয়ের গামলা ভরে ইফতার দেওয়া হয়। প্রতি গামলায় চারজনের ইফতারির ব্যবস্থা করা হয়। মসজিদের ভেতরের এই আয়োজনের পাশাপাশি মসজিদ–সংলগ্ন দক্ষিণ পাশের কড়ইগাছতলায় চলে আরেক দলের ইফতার বিতরণ।
মাজারের খাদেম আমজাদ হোসেন বেঙ্গল প্রেস’কেকে বলেন, প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার রোজাদার এখানে ইফতার করেন। এখানে পুরুষের পাশাপাশি মসজিদের উত্তর পাশে রয়েছে নারীদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা। প্রায় ৪০০-৫০০ নারীও এই মাজারের ইফতারে অংশ নেন। ইফতারে পানি পান করার জন্য দুই থেকে আড়াই হাজার গ্লাস রয়েছে। মাজারের ভক্তরাই পাঠান এসব ইফতার।
তিনি জানান, ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে ইফতারে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কমে আসছিল। গত বছরও কম ছিল। তবে, এবারের ইফতারের আয়োজন আগের মতোই হচ্ছে বলেন জানান তিনি।
আমজাদ হোসেন আরও বলেন, প্রতিদিন এখানে ৬০ কেজি মুড়ি, এক মণ ছোলা, ৫০ কেজি খেজুর, ৫০ কেজি চিনি লাগে। এছাড়া জিলাপি, পেঁয়াজু ও বেগুনিও প্রায় এক মণ করে পরিবেশন করা হয়। গত ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে এমন ইফতারের আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সুপ্রিম কোর্ট মাজারের এমন অসংখ্য ভক্ত রয়েছেন, যারা এখানে থাকেন। রমজান মাসে ভক্তদের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় এখানে। আর এসব খাবারের ব্যবস্থাও করেন মাজরের অন্য ভক্তরা। তারা টাকা বা খাবার দিয়ে থাকেন, আমরা আয়োজন করি, যোগ করেন মাজারের খাদেম আমজাদ হোসেন।
মানুষের দান এবং মাজার কমিটির ব্যবস্থাপনায় মাহে রমজানে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ ইফতার করেন মাজার মসজিদে। এমনকি করোনাকালে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সুপ্রিম কোর্ট মাজারে রমজান মাসে ইফতার আয়োজন চালু ছিল। আর গত ৭০ বছর ধরে এখানে দুপুরে ও সন্ধ্যায় লঙ্গরখানা চলছে। শুধু গরিব-ভিক্ষুকরাই নয়, অনেক ধনীরাও এখানে ইফতার করেন। শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী এখানে কাজ করেন।
মাজারে ইফতার করতে আসা এক রিকশাচালক বেঙ্গল প্রেস’কেকে বলেন, এই প্রথম মাজারের মসজিদে ইফতার করলাম। অনেক ভালো লাগলো। এখানে ইফতার শেষে অনেক সুন্দর করে দোয়া করা হয়।
বঙ্গবাজার মার্কেট থেকে আসা মিরাজ মিয়া বেঙ্গল প্রেস’কেকে বলেন, ইফতারির আগে বাসায় যাওয়ার জন্যে বের হলাম, রাস্তায় জ্যাম আর বাসায় গিয়ে ইফতার করতে পারবো কিনা অনিশ্চিয়তাও ছিল। আবার আমি মাজার ভক্ত, মাঝে মধ্যেই আসি। রমজান মাসে সুপ্রিম কোর্ট মাজারে ইফতারের আয়োজন খুব সুন্দর ভাবে করা হয়। এর আগেও আমি এখানে ইফতার করেছি। আজও আসলাম। খুব ভালো লাগে এখানে অনেক মানুষের সঙ্গে ইফতার করে।
ইফতার করতে আসা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম বেঙ্গল প্রেস’কেকে বলেন, এখানে ইফতারির খুব ভালো আয়োজন হয়। আমরা প্রতিবছর কোনো না কোনো সময় এখানে ইফতার করতে আসি। তিনি বলেন, মসজিদ শুধু প্রার্থনার জায়গা নয়। মসজিদে ইফতারের এমন উদ্যোগ মূলত ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের সেতু এবং সাম্য বজায় রাখার একটা উদাহরণ। এখান থেকে মানুষ ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের ভিত্তিতে গড়া ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা পায়।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট মাজার ও মসজিদ প্রশাসন কমিটির সচিব মো. আব্দুল রহমান বেঙ্গল প্রেস’কেকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট মাজার মসজিদে শত শত মানুষের জন্যে পর্যাপ্ত ইফতারের আয়োজন করা হয়। আগত লোকজন ও ভক্তদের সেবায় যথাযথ লোকবলও রয়েছে। তাই আমরা চাই, এখানে যারা আসেন তারা যেন কোনো দুর্ভোগে না পড়েন। তিনি বলেন, এ মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে অনেক সামাজিক কার্যক্রমও করা হয়।
সুপ্রিম কোর্ট মাজারে ছিন্নমূল মানুষের বসতি। তারা অপেক্ষায় থাকেন রমজান মাসের। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনেকেই রমজানে রোজাদারদের জন্য ইফতারের আয়োজন করে থাকেন। তাই ইফতারের অনেক আগে থেকেই ছিন্নমূলদের অনেকে ভিড় করেন মাজারে। সেখানে বছরের প্রতি মাসের দিনরাত ভিক্ষা করেন শত-শত ভিক্ষুক। এর মধ্যে শবে বরাত, রমজান ও শবে কদরে ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়ে যায়। ফলে এখানে যারা ইফতার করেন তাদের অনেকেই ভিক্ষুক। তবে কারও পেশা এখানে মুখ্য নয়, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে ধনী-গরিব সবাই একসঙ্গে বসে এখানে ইফতার করেন।
এফএইচ/কেএসআর/এমএস