ডেস্ক রিপোর্ট :
‘ঈদ সব সময়ই আনন্দের। কিন্তু সন্তানহারা বাবা-মায়ের কাছে ঈদ দুঃখের। আনন্দ করতে চাইলেও মন সায় দেয় না। এটা অন্যরকম কষ্টের। মঙ্গলবার (৩ মে) ঈদুল ফিতর। ভোরে ঘুম থেকে উঠে সন্তানের (মেয়ে) কবরে যাবো। জিয়ারত করবো। আল্লাহর কাছে দোয়া করবো। এতে হয়তো মনটা হালকা হবে।’
ঈদুল ফিতরের আগের দিন সোমবার (২ মে) বিকেলে শাহজানপুরে নিজ বাসায় বেঙ্গল প্রেস’কেকে কথাগুলো বলছিলেন সামিয়া আফরান প্রীতির বাবা জামাল উদ্দিন। গত ২৪ মার্চ রাজধানীর শাহজানপুরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে কলেজছাত্রী প্রীতি নিহত হন। তার মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তার বাবা-মা। বদরুন্নেসা সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান প্রীতি। তার ছোট ভাই এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
মঙ্গলবার (৩ মে) প্রীতি হত্যার ৪০ দিন পূর্ণ হবে। একই দিন ঈদুল ফিতর। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার ফাঁকে মেয়েকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন তার বাবা জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে সব সময় হাসিখুশি থাকতো। তার কোনো চাহিদা ছিল না। তার মায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। যত চাহিদা সব মাকেই বলতো। তার মামা-খালারা সব সময় তাকে ঈদে জামাকাপড় উপহার দিতো। আমার তেমন সামর্থ্য ছিল না। তেমন কিছু মেয়েকে দিতে পারিনি। এখন খুব আফসোস হচ্ছে।’
অর্থ সংকটের কারণে ঈদের ছুটিতে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তেমন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হতো না জানিয়ে জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি মিরপুরে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে সংসারই চালাতে পারি না। ছেলে-মেয়েদের সব আবদার পূরণ করতে পারিনি। বছর দুয়েক আগে একবার হাতিরঝিলে পরিবার নিয়ে ঘুরতে গেছিলাম। ওইদিন সবাই খুব মজা করছিল।’
ঈদুল ফিতরের পর ফ্রিল্যান্সিং শেখার জন্য মেয়েকে একটি ল্যাপটপ কিনে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল জানিয়ে জামাল উদ্দিন বলেন, আমার মেয়েটা মারা যাওয়ার তিন-চার মাস আগে খিলগাঁওয়ে একটা রেস্তোরাঁয় কাজ করতো। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে বসুন্ধরা সিটিতে একটা কোম্পানিতে চাকরিও পেয়েছিল। ১ এপ্রিল কাজে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। মাসে বেতন ১৫ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে আমাদের সবাইকে ঈদের জামা কিনে দেবে বলেছিল। কিন্তু তা আর হলো না।
গল্পের এক পর্যায়ে প্রীতির পড়ার রুমে নিয়ে যান বাবা জামাল উদ্দিন। টেবিলে সাজিয়ে রাখা বইপত্র দেখিয়ে জামাল বলেন, আমার মেয়েকে পড়াশোনার জন্য মেয়েকে কখনো বকতে হয়নি। নিজ থেকেই পড়াশোনা করেছে। বদরুন্নেসা সরকারি কলেজে আমি শুধু ভর্তি করিয়েছি। মেয়ে সব সময় একাই কলেজে যেত।
সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রীতি নিহত হলেও কেন থানায় মামলা করেনি, এমন প্রশ্নের জবাবে জামাল উদ্দিন বলেন, বিচার না চাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল মামলার দীর্ঘসূত্রতা। আমরা নিরীহ মানুষ। আর্থিক সামর্থ্য নেই। মামলা করা বা মামলা চালানোর মতো কোনো সক্ষমতা নেই। তাই মনকে সান্ত্বনা দিলাম, যারা আমাকে সন্তানহারা করেছে, আল্লাহ তাদের বিচার করুন।
তিনি বলেন, ২৪ মার্চের ঘটনায় টার্গেট ছিল মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু। তাকে উদ্দেশ্য করেই এলোপাতাড়ি গুলি করেছিল সন্ত্রাসীরা। এসময় মিস ফায়ারে আমার মেয়ে মারা যায়।
প্রীতির মৃত্যুর পর সারাদেশে প্রতিবাদ হয়। নানা কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। আজ প্রীতির বাবাকে ২০ লাখ টাকার ডিপোজিট করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুপুরে ধানমন্ডি ৩ নম্বরে এই ডিপোজিটের কাগজ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া।
এ বিষয়ে জামাল উদ্দিন বলেন, আমার সংসারে বড় মেয়ে ছিল প্রীতি। তাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। এমন অবস্থায় আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার এমন উদারতায় আমরা কৃতজ্ঞ।
প্রীতির বাবার সঙ্গে যখন কথা বলছি, পাশের রুমে বসে জামাকাপড় সেলাই করছিলেন মা হোসনে আরা। মেয়ের কথা জানতে চাইলে মুহূর্তেই মুখটা মলিন হয়ে দুচোখের কোণে পানি জমে যায়। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।
এমএমএ/এএ/এমএস