স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের উপস্থিতিতে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন টেকনাফ উপজেলার হ্নীলার পশ্চিম লেদার ইয়াবা সম্রাট বোরহান উদ্দিন (৪০)।
দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জামিনে বেরিয়ে এসে ফের মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। সম্প্রতি তার কয়েকটি বড় বড় ইয়াবা ও আইসের চালান ধরা পড়ার পর ফের নতুন করে আলোচনায় আসে বোরহান। আগে একাধিক মামলা থাকলেও এইসব মাদক উদ্ধার, অস্ত্র ও অপহরণের ঘটনায় গত তিন মাসে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে অন্তত ৫টি।
ইয়াবা কারবারের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির আত্মীয়-স্বজনসহ কক্সবাজার জেলা আ.লীগের শীর্ষ এক নেতার ঘনিষ্ঠ বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বোরহান আগের রূপেই ফিরেছে। তিনি অপহরণ বানিজ্য, ইয়াবা ও আইস কারবারে ফের জড়িয়ে পড়েছেন জামিনে ফেরার পর থেকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানান, রোবহানের বিরুদ্ধে ঢাকার রমনা থানা, মুগদা থানা, কক্সবাজার সদর থানা ও টেকনাফ থানায় অপহরণ, অস্ত্র ও মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে অর্ধডজনের বেশি মামলা রয়েছে। সর্বশেষ গত ২৯ আগস্ট তার এম্বুলেন্সে করে পাচারকালে একটি ইয়াবার চালান কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের মুহুরীপাড়াস্থ আলী আহমদ অটো রাইচ মিলের সামনে জেলা গোয়েন্দা সংস্থার হাতে আটক হয়। এতে প্রায় এককোটি ঊনষাট লাখ টাকা মূল্যের ৫৩ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে কক্সবাজার সদর থানায় তার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার মামলা নং ৭৩/৪৮৭।
প্রতিবেদকের হাতে আসা কয়েকটি মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ২ আগষ্ট ঢাকার রমনা থানায় বোরহানের ৮ হাজার পিস ইয়াবার একটি চালান জব্দ করা হয়। সেখানে তাকে ৭ নম্বর আসামী করা হয়েছে। যার মামলা নং ৪/১৫৭। গত ২০ নভেম্বর ঢাকার মুগদা থানা পুলিশ ৪৪ হাজার ৮শ পিস ইয়াবার আরও একটি চালান জব্দ করে। যার মামলা নং ১৩/২১৯। এছাড়াও গত ৫ সেপ্টেম্বর টেকনাফ বিজিবি বোরহানের একটি মাদকের চালান জব্দ করে। এসময় ১০ হাজার পিস ইয়াবা ও ১ কেজি ৬৫ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইস উদ্ধার করা হয়। যার মামলা নং ১৪/৬৩২। তার বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় গত ৫ সেপ্টেম্বর একটি অস্ত্র মামলা রুজু করা হয়। যার নং ১৫/৬৩৩। এছাড়াও গত ১৭ জুলাই টেকনাফ থানায় একটি অপহরণ মামলাও হয়।
অভিযোগ উঠেছে, ওইসব মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) থেকে নাম বাদ দিতে এখন কোটি টাকার মিশনে নেমেছেন বোরহান। এমনকি মামলাগুলোর তদন্তকারি কর্মকর্তাদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এক প্রকার প্রাথমিক আলোচনা শেষ হয়েছে জানিয়ে দাম্ভিকতা দেখাচ্ছেন বোরহান উদ্দিন নিজেই।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, টেকনাফ থানার ওসি (অপারেশন) আব্দুর রাজ্জাকের সাথে ইয়াবা সম্রাট বোরহানের সখ্যতা রয়েছে। তিনিই মোটা অংকের অনৈতিক সুবিধা নিয়ে তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগীতা করছেন। দীর্ঘদিন টেকনাফ থানায় কর্মরত থাকার সুবাদে আব্দুর রাজ্জাকের সাথে মাদক কারবারিদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরী হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
তবে এইসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন টেকনাফ থানার ওসি (অপারেশন) আব্দু রাজ্জাক। তিনি বলেন, মাদক কারবারিদের সাথে আমার কোন সখ্যতা কিংবা যোগাযোগ থাকার বিষয়টি একেবারেই ভিত্তিহীন। একরম কোন প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবেনা। অভিযুক্ত বোরহানের মামলা আমাদের একজন এসআই দেখভাল করছেন। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রয়োজনে আমি যেকোন সহযোগীতা করবো।
অনুসন্ধানে জানা যায়, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলার ৮ নং ওয়ার্ডের পশ্চিম লেদার বাসিন্দা মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে বোরহান উদ্দিন। কৃষক পিতার অভাবের সংসারে বাস করতেন জরাজীর্ণ একটি বাসায়। অর্থিক অনটনে পড়া লেখায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোতে পারেনি। জীবন যুদ্ধে নেমে কাজ নেন জিপ গাড়ির হেলপার হিসেবে। দু’বছর যেতে না যেতেই হয়ে উঠেন জিপ চালক। এরপর থেকে জিপ চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা বোরহান উদ্দিনের উত্থানের কাহিনী সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০১২ সাল পর্যন্ত জিপ চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসলেও ১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে আত্মস্বীকৃত কয়েকজন ইয়াবা ডনসহ তার ঘনিষ্ঠ চার বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেন মিয়ানমার-টেকনাফ কেন্দ্রিক একটি মাদক পাচারকারী সিন্ডিকেট। এরপর থেকে তাদের পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। এই সিন্ডিকেটে অন্যতম ছিলেন জিপ চালক বোরহান। প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ও অত্মস্বীকৃত কক্সবাজারের ঝিলংজার লারপাড়া এলাকার ইয়াবা সম্রাট শাহ জাহান আনসারী। সিন্ডিকেটটিতে ছিলো টেকনাফের ক্ষমতাসীন দলের নেতা, হুন্ডি ব্যবসায়ী স্থানীয় দোকানদারসহ আরো অনেকে।
টানা ৮ বছর একযোগে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে হয়ে যান বিপুল বিত্তভৈববের মালিক। এরপর থেকে গড়ে তুলেন ইয়াবা সম্রাজ্য। কিছুদিন ব্যবসা চালিয়ে যেতে না যেতেই দেশব্যাপি মাদক বিরোধী অভিযান শুরু হলে প্রাণ বাঁচাতে ১০২ জন ইয়াবা কারবারিদের সাথে আত্মসমর্পণ করেন। কারাগারে বসে নিয়ন্ত্রণ করেন মাদক ব্যবসা। পাচার করেন কোটি কোটি টাকা। পরে ২০২০ সালে জেলা পুলিশের নতুন সেটআপ আসলে জামিনে রাজার হালতে ফিরে আসেন তিনি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন ইয়াবা পাচার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে থেকে যান ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক সময়ের রিক্তহস্ত বোরহান নাফ নদীর সাথে লাগোয়া দমদমিয়া এলাকায় ক্রয় করেছেন দেড় একর জমি। টেকনাফের আউলিয়াবাদ এলাকায় এক তলা ভবনসহ ক্রয় করেছেন বিপুল জমি। সেখানে গড়ে তুলেছেন বহুতল ভবন। উখিয়ার মরিচ্যা, হ্নীলার লেদা ও জাদিমুরা এলাকায় রয়েছে ৩টি ইটভাটার শেয়ার। এছাড়াও পশ্চিম লেদার নিজ এলাকায় তৈরী করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। কক্সবাজার শহরে রয়েছে বহুতল ভবনে একাধিক ফ্লাট। রয়েছে ৪ টি মিনিট্রাক। এই গাড়িগুলো মূলত মাদক পাচারের কাজে ব্যবহৃত হয় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন এলাকায় নামে-বেনামে ক্রয় করেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি।
স্থানীয়রা জানান, বোরহান উদ্দিন একজন চিহ্নত মাদক ব্যবসায়ী। বর্তমানে সে জামিনে ফেরার পর থেকে পুরনো ইয়াবা সিন্ডিকেটটি সক্রিয় করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের অভিযোগ, আগে গোপনে মাদক ব্যবসা করলেও গত দুই বছর ধরে অনেকটা প্রকাশ্যে তার মাদকের চালান যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। নিরাপদ রোড হিসেবে ব্যবহার করছেন সগর পথ।
স্থানীয়দের মতে, কথিপয় পুলিশ অফিসার ও মাদক সম্রাটদের সাথে সখ্যতা থাকায় টেকনাফ এখন অনেকটা স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। মাদক ব্যবসায় নিত্য নতুন জড়িয়ে পড়ছে বোরহানদের মতো নিন্মবিত্ত পরিবারের অনেকে। গাড়ি চালক ও কর্মচারীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে বোরহানরা কোটি কোটি টাকার মাদকের চালান অনায়াসে পাচার করে আসছে দেশের বিভিন্ন গ্রান্তে। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বোরহানদের বেশ কয়েকজন পাচারকারি আটক হলেও কমছে না মাদকের ভয়াবহতা।
টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নিরাপত্তা কিছুটা শিথিল থাকায় মাদক কারবার হচ্ছে। মোটরসাইকেলে করে উঠতি বয়সী যুবকরা ঘোরাফেরা করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনাফ এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, জামিনে আসা মাদক কারবারিরা ফের একই কারবারে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বোরহানসহ তার সিন্ডিকেটটি অনেকটা বেপরোয়াভাবে চলাফেরা করছে। তার মধ্যে কেউ কেউ গত নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছেন। বাকীতে মাদক বিক্রির পর টাকা নিয়ে ঝামেলা হলে অপহরণ করে সেই টাকা উদ্ধার করা হয় বলে জানা গেছে।
এদিকে বোরহানসহ মাদক কারবারে জড়িত অন্তত অর্ধশত গডফাদার এখনো আছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ উঠেছে, তাদের ধরতে আগ্রহও নেই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর। এমনকি গডফাদারদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরেও বেড়াচ্ছে।
এবিষয়ে জানতে বোরহানের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি বাড়িতে গিয়েও তার খোঁজ মেলেনি।
টেকনাফ থানার ওসি জুবাইর সৈয়দ বলেন, আজ হোক কাল মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আসবে। আত্মস্বীকৃত কারবারীদের প্রতি পুলিশের কঠোর নজরদারি রয়েছে। ব্যবস্থা নিতে বোরহানের নাম-ঠিকানাসহ তথ্য দিয়ে সহযোগীতা করতে বলেছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
সালাউদ্দিন/সাএ