কক্সবাজারের টেকনাফে গত কয়েক বছর ধরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে অপহরণকারীরা। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা ঢলের শুরুর দিক থেকে গতমাস পর্যন্ত প্রায় শতাধিক অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার শিকার হয়েছে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, শিশুসহ মধ্যবয়সীরা। অপহরণের সময় দুর্বৃত্তরা কখনো কখনো নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে গহীন পাহাড়ে নিয়ে বিপুল পরিমান মুক্তিপন আদায় করেছে অপহরণকারীরা।
চলতি বছরের ১৬ জুলাই রাতে টেকনাফের হ্নীলার পূর্ব লেদা এলাকা থেকে জাহাঙ্গীন নামের এক যুবককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়া অপহরণকারীরা। কিছু সময়ের মধ্যেই তাঁর ভাই হ্নীলার ৮ নং ওয়ার্ড আ.লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলমের মুঠোফোনে ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে দ্রুত সময়ে টাকা না দিলে ভাইকে হত্যার হুমকি দেন অপহরণ চক্রটি। পরে দর কষাকষির এক পর্যায়ে প্রাণ বাঁচাতে ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণে অপহৃত জাহাঙ্গীর ফিরে এলেও এখনো অধরাই থেকে গেছেন অপহরণ চক্রের মূলহোতারা। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগী পরিবারের।
তাদের দাবি, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক বিরোধের জেরে অপহণের ঘটনাটি সংঘটিত করেছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র। যার মুল পরাকল্পনাকারী ছিলেন আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারি ও ৪ ডজন মামলার আসামী স্থানীয় নুরুল হুদা মেম্বার। তাঁর ভাই নুরুল কবির, গবির সুলতানের ছেলে মোস্তাক আহমদ ও আব্দুস সালামের ছেলে দিল মোহাম্মদ। প্রথমে এই মাদক মাফিয়ারা মাষ্টারমাইন্ড হিসেবে জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে না আসায় তাঁদের আসামী করা হয়নি। পরে তাঁদের মূল পরিকল্পনায় অপহণ সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলেও পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে এখনো দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেন নি। এর আগেও এই ৪ জনের বিরুদ্ধে বহুমাত্রিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ থাকলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় চক্রটি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
অপহৃত জাহাঙ্গীর আলম জানান, গত ১৬ জুলাই রাত ১১টার দিকে আমি কয়েকজন বন্ধুদের সাথে পূর্ব লেদার আবু তাহেরের বাড়িতে গল্পরত ছিলাম। এমতাবস্থায় মাস্ক পরা স্বশস্ত্র একটি দল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে স্থানীয় মোস্তাক আহমদ সওদাগরের বাড়ির সামনে দাড়ানো একটি নোহা গাড়িতে জোরপূর্বক তোলার চেষ্টা করে। এসময় গাড়িতে থাকা স্থানীয় ইয়াবা সম্রাট বোরহানের গাড়ি চালক মোচনীর সোলতান আহমদ প্রকাশ টোকাইয়া, পূর্ব রঙ্গিখালীর ইয়াসিন আরফাত, গাজী পাড়ার শাহ আলম ও আবছারসহ আরও কয়েকজনকে দেখতে পায়। আমি গাড়িতে উঠতে না চাইলে তাদের হাতে থাকা বন্দুকের বাট ও টর্চলাইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে জোর করে গাড়িতে তুলে উলুচামরী পাহাড়ি ছড়ার মাথায় চক্রটির অন্যান্য সদস্যদের হাতে তুলে দিয়ে যায়। এরপর গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় খবর পেয়ে স্থানীয়রা হোয়াইক্যং নয়াবাজারের প্রধান সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে গাড়িটি জব্দ করে পুলিশে খবর দেয়।
এসময় অপহরণে ব্যবহৃত গাড়ীর ভেতরে থাকা পশ্চিম লেদার হোছন আহমদের ছেলে গাড়ি চালক মহিব উল্লাহ, মোচনীর তাজর মুল্লুকের ছেলে সোলতান আহমদ প্রকাশ টোকাইয়া, কক্সবাজার সদরের খরুলিয়ার সব্বির আহমদের ছেলে মোঃ রাশেদুলকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয় জনতা।
জাহাঙ্গীর আলম আরও জানান, আমাকে অপহরণের কাজে ব্যবহৃত গাড়ীসহ তাদের তিন সদস্য ধরা পড়ার বিষয়টি তখন জানতে পেরে চক্রটি আমাকে গহীন পাহাড়ে নিয়ে যায়। পরে তারা আমার ভাই আ.লীগ নেতা মোহাম্মদ আলমের মুঠোফোনে কল করে প্রথমে ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে অপহরণকারিদেরকে ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে আমি ফিরে আসি।
জাহাঙ্গীরের ভাই হ্নীলার ৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলম বলেন, আমার ভাইকে অপহরণের ঘটনায় জড়িত পশ্চিম লেদার মৃত নুরুল ইসলামের পুত্র বোরহান উদ্দিনকে প্রধান আসামী করে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ১০ থেকে ১২ জনকে অজ্ঞাত আসামী করে টেকনাফ থানায় একটি মামলা দায়ের করি। কয়েকদিন পর জানতে পারি এই ঘটনার মাষ্টারমাইন্ড ছিলেন ইয়াবা ডন নুরুল হুদা মেম্বার, তাঁর ভাই নুরুল কবির, মোস্তাক আহমদ ও দিল মেহাম্মদ। মুলত তারা পূর্ব শত্রুতার জেরে হত্যার উদ্দ্যেশে আমার ভাইকে অপহরণ করেছিলো। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় মুক্তিপণে তাঁরা আমার ভাইকে ছেড়ে দেন।
আ.লীগ নেতা আলম অভিযোগ করে বলেন, আমার ভাইকে অপহরণের ঘটনাটি সংঘটিত করতে কয়েকবার বিভিন্ন জায়গায় পরিকল্পনা করেছেন বলে নুরুল হুদা মেম্বার নিজেই স্বীকার করেছেন হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের একটি বৈঠকে। এসময় পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী ও প্যানেল চেয়ারম্যান
আবুল হোছাইনসহ বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এখন পুলিশ তাঁদের ওই মামলায় গ্রেফতার কিংবা আসামী করছেনা। উল্টো তাঁদের অব্যাহত হুমকি-ধামকিতে ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছি।
এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জাহাঙ্গীরকে অপহরণ করার পরিকল্পনা করেছেন বলে নুরুল হুদা মেম্বারের স্বীকারোক্তি দেয়া ও তাঁরা কয়েকবার বৈঠক করে পরিকল্পনার দায় স্বীকার করতে একটি ভিডিও রেকর্ডও এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। ১১ মিনিট ২২ সেকেন্ডের এ ভিডিও রেকর্ডে উক্ত জাহাঙ্গীরকে অপহরণের মুল মাষ্টারমাইন্ড নুরুল হুদা মেম্বার, তাঁর ভাই নুরুল কবির, মোস্তাক আহমদ সও, দিল মোহাম্মদ জড়িত থাকার বিষয়ে মামলা বাদী আলমের অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। আলম আরও জানান, বিষয়টি তিনি পরিষদের চেয়ারম্যান-প্যানেল চেয়ারম্যানের সামনে স্বীকার করেছেন নুরুল হুদা মেম্বার নিজেই। অথচ পুলিশ এখন তাঁদের রহস্যজনক কারণে গ্রেফতার কিংবা আসামী করে গড়িমসি করছে।
এদিকে স্থানীয়রা জানান, নুরুল হুদা মেম্বারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সন্ত্রসী বাহিনীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ওই এলাকার হাজার সাধারণ মানুষ। এই বাহিনীটি এক যুগের বেশি সময় ধরে নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। এই বাহিনীর প্রধান নুরুল হুদা। তাঁর ভয়ংকর কর্মকাণ্ড খুলনার এরশাদ শিকদারকেও হার মানিয়েছে। ৪ ডজন মামলার ঝুলি মাথায় নিয়ে বর্তমানে তিনি নিজেই একচ্ছত্রভাবে সন্ত্রাসী রাজত্ব বলবৎ রেখেছে। এ বাহিনীটি দীর্ঘ একযুগের বেশি সময় ধরে এলাকায় মাদক ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তার, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, অস্ত্র ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে আসছে।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আবুল হোছাইন বলেন, পরিষদের এক মিটিংয়ে জাহাঙ্গীরকে অপহরণের বিষয়টি স্বীকার করেছেন নুরুল হুদা মেম্বার নিজেই। তবে নুরুল হুদারা মেরিন ড্রাইভের কয়েকটি এলাকায় বসে একাধিকবার পরিপল্পনা করলেও অপরণের সময় তাঁরা অংশগ্রহণ করেন নি; যারা ওই ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন তারাই মূলত এই ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে এসময় নুরুল হুদা দাবি করেছেন।
এই অপহরণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা টেকনাফ থানার এসআই ফয়সাল বলেন, ওই মামলায় গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে যারা কারাগারে রয়েছে; তারা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তদন্ত করে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হবে এবং তাঁদের ওই মামলায় আসামী করা হবে।
শাকিল/সাএ