আ ম ন জামান চৌধুরী সিলেট
এক দশক ধরে সিলেট সিটি করপোরেশনের মসনদ হারিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ । ১৪ সাল এবং২০১৮ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে হেরে যান আওয়ামীলীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী প্রয়াত বদরুদ্দীন আহমদ কামরান। সে’বারও এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাতে হাত রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেদের মধ্যে ঐক্যের জানান দিয়ে ছিলেন সিলেট জেলাও মহানগর আওয়ামীলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব গুছাতে পারেনি কেন্দ্রীয় কঠোর নির্দেশনা। মিছিল মিটিংয়ে অনেক নেতা প্রকাশ্য উপস্থিত থাকলেও ভেতরে ভেতরে কাজ করেন আরিফুল হকের পক্ষে নিজেদের গ্রুপের নেতাকর্মীদের সেভাবেই নির্দেশ দিয়ে রাখেন নির্বাচনের শেষ মুহুর্তে। যার ফল ছিলো ১৮ সালে লজ্জাজনক হার । এরজন্য নৌকার প্রার্থীর নিজেরও ছিলো কিছু ভয়াবহ ভুল। তিনি নিশ্চিত নির্ভার ছিলেন তিনি জিতবেন যার ফলে কিছু গোপন চুক্তি বা লেনাদেনা করে ছিলেন কাউন্সিলর প্রার্থীদের সঙ্গে এমন কি বিএনপির কিছু কাউন্সিলর প্রার্থীর সঙ্গে সেই চুক্তি বাস্তবায়ন হয়ে গিয়েছিলো আগের রাতে । একটি বিশেষ সংস্থার সূত্র নিশ্চিত করেছিলো সেদিন, নৌকার প্রার্থী এরকম নিশ্চয়তা দিয়ে তিনি বেশ কিছু কাউন্সিলর প্রার্থীকে ফোন করিয়েছেন তার বিশেষ প্রস্তাবে রজি হলে তার সঙ্গে তাদের বিজয়কেও নিশ্চিত করা হবে। নিজের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে মেয়র হয়ে আসছেন এই নিশ্চয়তা দিয়ে ছিলেন, তারাও যদি সিটি করপোরেশনে আসতে চায় তাহলে তার প্রস্তাবে সাড়া দিলে কামিয়াব করা হবে। এতসব লেনদেন গোপন বিষয়াদিতে বিএনপির একজন রানিং কাউন্সিলর প্রার্থীর ভাই ওয়ার্ড আওয়ামিলীগ নেতা জড়িত ছিলেন। অথচ কি দুর্ভাগ্য রাত তিনটায় একটি শক্তিশালী বিশেষ সংস্থা তখনো জানিয়ে গিয়েছিলো যে তাঁর অবস্থা ভালো নয়। তিনি কর্ণপাত করেননি। এটা জানতেন আওয়ামিলীগের অন্যান্য নেতারা কিন্তু তাঁরা কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি এমনকি খুব বেলা পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন নেতাকে ভোট কেন্দ্রে দেখা যায়নি। বেলা বাড়ার আগেই যে প্রক্রিয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে হারাবার আয়োজন ছিলো সেটি বোমেরাং হয়ে নিজেদের পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাত দুটোয় ছড়ারপাড় মসজিদে যে চুক্তি হয়েছিলো বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী এবং একজন বিশেষ প্রার্থীর ভাই ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের নেতা তাঁর ভাইয়ের বিজয় নিশ্চিত করতে মসজিদ থেকে সমস্ত পরিকল্পনা ততক্ষণাৎ ফাঁস করে দেন । পরিকল্পনা মাফিক যে পরিচয়পত্রটি গলায় ধারণ করে কেন্দ্রে প্রবেশ করবে বিশেষ কর্মীরা সেই কার্ডটি একঘন্টার মধ্যে ক্লোন হয়ে ছাত্রদলের হাতে হাতে পৌঁছে যায় ফলে আওয়ামীলীগ প্রার্থীর সম্পূর্ণ ফর্মূলাটি ব্যবহৃত হয় ছাত্রদলের মাধ্যমে প্রতিটি কেন্দ্রে । এর সঙ্গে বিএনপি দলীয় একজন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থীও সংশ্লিষ্টতা ছিলো এবং তারা নির্বাচনে জিতে ছিলেন, শুধু হেরে গিয়ে ছিলেন ফর্মূলার কারিগর। সেদিন কেবল তিনি ভোটেই শুধু হারেননি তাঁর আত্মবিশ্বাস এবং তাঁর দলের বিশ্বাসভঙ্গকারীদের কারণেও তিনি রাজনৈতিকভাবে হেরেছিলেন। একজন প্রার্থীর নিজের রাজনীতি এবং নিজের কর্মকাণ্ডের প্রতি যে আস্থা ছিলো অটুট সেই দৃঢ়তাও সেই রাতে বহুবার উচ্চারিত হয়েছিলো আওয়ামীলীগ প্রার্থীর মুখে । তাঁকে জানানো হয়েছিলো এই সংখ্যক ভোট নিশ্চিত করা গেছে তবে তা যথেষ্ট নয়, তিনি সে সময় দৃঢ়তার সঙ্গে নাকি বলেছিলেন আমি কি সারা জীবন ঘাস কেটেছি মানুষের জন্যে কিছুই করিনি? এনাফ এনাফ । না দুর্ভাগ্য ক্রমে সেটা এনাফ ছিলনা সাধারণ ভোটার এবং দলের নেতাকর্মীর ওপর যে আস্থা বা বিশ্বাস তিনি রেখে ছিলেন সেটার কাঙ্ক্ষিত ফল পাননি বদরুদ্দীন আহমদ কামরান। ২০২৩ সালে এসে আবারো দলীয় সেই মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব মাথাচাড়া দিয়ে না উঠলে দূরত্ব এবার কমবেশি আছে । এবারে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী একজন ক্লিন ইমেজের মানুষ। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবার সঙ্গে রয়েছে পরিচিতি এবং সদভাব। যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান সমালোচনার ঊর্ধ্বে । ব্যক্তি হিসেবে অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। সিলেটের রাজনীতিতে তিনি কখনোই ছিলেন না ছাত্ররাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো পদপদবীধারীও ছিলেন না। ছাত্র জীবনেই যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান এবং সেখানকার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বছর কয়েক ধরে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের স্থানীয় রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। সিলেটের বিশ্বনাথ – বালাগঞ্জ ওসমানী নগর সংসদীয় আসনে তাঁর নিজ বাড়ী সেখানকার সংসদীয় আসনে নির্বাচন করার তোড়জোড় করে আসছেন যদিও এই আসনটিতে একবার নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন বর্তমান সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সফিকুর রহমান চৌধুরী। গত দুই টার্ম ঐক্যজোটকে আসনটি ছেড়ে দেওয়া হয় । সফিকুর রহমান চৌধুরী আসনটিতে দুবারই দলীয় নমিনেশন প্রত্যাশী ছিলেন তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় আসনটির টিকেট চাইবেন। এদিকে এই আসনটিতে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীও দাবীদার এনিয়ে বছর কয়েক ধরে এই দুই নেতার মধ্যে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য দ্বন্দ্ব চলে আসছে সম্ভবত এই দুই নেতার মধ্যে ভাগবাটোয়ারায় আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে সিলেট সিটি করপোরেশনে থিতু করতে দলীয় নমিনেশন দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সিলেটের আওয়ামীলীগ রাজনীতিতে পোড় খাওয়া অনেক নেতা সিটির নমিনেশন পাওয়ার জন্য মনোনয়ন ক্রয় করে ছিলেন কিন্তু দল আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকেই উপযুক্ত মনে করে সবাইকে তাঁর হয়ে কাজ করতে বলে। সিলেটের নবীন প্রবীন অনেক নেতা দলীয় সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। কেউই বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার দুঃসাহস দেখায়নি।
সিলেটে বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন সাবেক ছাত্র নেতাদের নিজস্ব বলয় রয়েছে একেক ভাইয়ের একেক বলয়ে গ্রুপ রাজনীতি বেশ পরিচিত। বলয় ভিত্তিক নেতারা এখন জেলা মহানগর ও কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন ফলে ছাত্র রাজনীতি এবং দলীয় রাজনীতিতে তারা বেশ প্রভাব রাখেন। বাইরে ঐক্যের ভাব দেখালেও ভেতরে ভেতরে তাঁদের মধ্যে দূরত্বটা বেশ স্পষ্ট এবং প্রকট।আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর নির্বাচনী প্রচারণায় তা বেশ পরিলক্ষিত হচ্ছে তৈরী হয়েছে একটা অনৈক্যের চোরাবালি যে চোরাবালিতে আটকে যেতে পারে জয়ের সম্ভাবনা । দলের ভেতরে থেকে দলের প্রার্থীকে ডুবাবার আয়োজন একেবারে নেহায়েত কম নয়। যদিও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ নতুন মুখ জাতীয় পার্টির লাঙ্গল মার্কা নিয়ে নির্বাচন করছেন এর আগে তিনি দুবার কাউন্সিলর নির্বাচনে এক রকম গো-হারা হেরেছেন সন্দেহ করা হচ্ছে এন্টি আওয়ামীলীগ ভোট যদি লাঙ্গল বেছে নেয় তাহলে লড়াইটা কঠিন হয়ে উঠবে আওয়ামিলীগ প্রার্থীর জন্য। পরিসংখ্যান এবং বিভিন্ন সংস্থার আভাস নৌকার জন্য বেশ হতাশাব্যাঞ্জক। সিলেট সিটিতে এন্টি আওয়ামীলীগ ভোটারের সংখ্যা অধিক অতীত নির্বাচনগুলো থেকে স্পষ্টই অনুমান করা যাচ্ছে। এবার সিটি করপোরেশনে সংযোজিত নতুন ১৫ ওয়ার্ড আওয়ামিলীগের জন্য দুশ্চিন্তার একটু বেশিই কারণ। বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সিলেটে অত্যন্ত জনপ্রিয় মানুষ তাঁর বিকল্প আগেও ছিলনা পরেও নেই এমনটাই ভাবছেন ভোটাররা । আরিফুল হক চৌধুরী যে ১৫টি ওয়ার্ড বাছাই করে সিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন সেইসব এলাকার ভোট নৌকায় পড়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ । এইসব পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকে সিটি করপোরেশনে নিয়ে আসার কৃতিত্ব আরিফুল হক চৌধুরীর সেকারণে কৃতজ্ঞতা বোধ সম্পন্ন মানুষদের ভোট নৌকায় না পড়ার বদলে লাঙ্গলে চলে যায় কিনা তা নিয়ে রয়েছে আওয়ামী শিবিরে আশংকা । আরিফুল হকের ভোট মানেইতো এন্টি আওয়ামীলীগ ভোট সেকারণে ভোটগুলো হিসাব উলটপালট করে দিতে পারে যে কারো বিজয়। আওয়ামীলীগ প্রার্থী ঠেকাতে যদি ভোট গুলি লাঙ্গলে যায় তাহলে নৌকার ভাগ্যে বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা বেশি। কার ভাগ্য কেমন হয় দেখার সময় খুব সন্নিকটে । নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের ধারণা একটা স্বচ্ছ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে যাচ্ছে সিলেট সিটি নির্বাচন । সাধারণ ভোটার থেকে রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষদের মধ্যে ভোট কারচুপির এই ভয়টি নেই বললেই চলে। তবে ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে দুশ্চিন্তা কম নয়। সিলেটে এ কয়দিন ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে এবং আবহাওয়া অফিস সূত্র বলছে ২১ তারিখের আগে আবহাওয়া পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই এই অবস্থায় ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ব্যাঘাত ঘটবে। এতসব বাদ দিয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি বিশ্লেষন করতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্রের রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত ফলাফল
আওয়ামিলীগ প্রার্থীর জন্য খানিকটা হতাশাজনক , সূত্র বলছে নৌকার বিজয় এ পর্যন্ত ফিফটি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়নি, তাহলে? দীর্ঘ চৌদ্দ বছর থেকে ক্ষমতায় থাকা এই দলটির সিলেটে এই অবস্থা কেন? সর্বত্র এই জিজ্ঞাসার সাবলিল কোনো উত্তর নেই রাজনৈতিক কোনো নেতার কাছে । বিভিন্ন অঙ্গনের সুধীজন এবং সাবেক কিছু রাজনৈতিক নেতারা বেশির ভাগই যা বলছেন তা বর্তমান আওয়ামীলীগ জন্য সুখকর নয়। তাঁরা বলছেন জনবিচ্ছিন্নতা এবং আত্ম অহামিকা এর প্রধান দুটি কারণ হতে পারে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থী নিয়ে আতঙ্ক আর ভরাডুবির ভয়ে আওয়ামিলীগ যে সন্ত্রস্ত তাতে অনুমান করা যায় নগরীতে রাজনৈতিক দল হিসেবে এবং দলের নেতাদের জনপ্রিয়তা কেমন । প্রতিপক্ষ হিসেবে মেয়র প্রার্থীরা দুইবারের জননন্দিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে পেলে কেমন হতো এ যাত্রা তা সাধারণ মানুষের কাছে অনুমেয়। ২০১৪ সাল কিংবা ২০১৮ সালের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব গুছিয়ে উঠুক সিলেটের আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব সাধারণ কর্মীদের প্রত্যাশা পুরণে নেতারা এই স্বল্প সময়ে অহমিকা ত্যাগ করতে পারবেন কিনা
বলা কঠিন।
কাল বাদ নির্বাচন ভাগ্য নির্ধারণে জনতার রায় কেমন হয় কার ভাগ্যে জোটে বিজয় মাল্য সেই অপেক্ষায় নগরবাসী ।সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হোক সিলেটে নিশ্চয়ই এমন প্রত্যাশা সকলের।