রবিন্দ্র জাদেজা যখন বাউন্ডারিটা মেরে দুই হাত প্রসারিত করে দৌড় দিয়েছিলেন, সতীর্থরা যখন ডাগআউট ছেড়ে প্রবল উল্লাসে মাঠে নেমে আসছিলেন, তখন নিজের চেয়ালে ঠায় বসে থাকলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। আকাশের দিকে মুখ করে দুই চোখ বন্ধ করলেন। যেন হাঁফ ছেড়ে স্বস্তির এক বিশাল নিঃশ্বাস ফেলে তিনি মনে মনে আত্মস্থ করছিলেন, ‘তাহলে চ্যাম্পিয়ন হলাম…!’
চোখ বন্ধ করে কী আরও কিছু ভেবেছিলেন ধোনি? সবাই তো ধরে নিয়েছে গুজরাটের বিপক্ষে ফাইনালই ক্রিকেট মাঠে খেলোয়াড় হিসেবে শেষ তার। এরপর হয়তো পোডিয়ামে উঠে ধোনি বলে দেবেন, ‘বয়স তো আর বাধ মানে না। সুতরাং আর নয়। এবার হাতের গ্লাভস, ব্যাট-প্যাডটা তুলে রাখতে চাই।’
কিন্তু না, ওই যে চোখ বন্ধ করেছিলেন! তাতে হয়তো নিজের ভবিষ্যৎটাও দেখে নিয়েছেন। যার প্রতিফলন ঘটলো আইপিএলের পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে সঞ্চালকের প্রশ্নে। জানিয়ে দিলেন, এখনই ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু চিন্তা করছেন না। ইঙ্গিত দিলেন, আগামী বছর আইপিএলেও দেখা যেতে পারে তাকে।
ধোনির কথা শুনে তো তুমুল হাততালি গ্যালারিতে। ভারতীয় ক্রিকেটে ভক্তদের হৃদয়ে ধোনি যে আসন গেঁড়ে বসেছে, ততটা শচিন-গাভাস্কার কিংবা কপিল দেবরাও পেরেছেন কি না সন্দেহ। তো সেই ভক্ত-সমর্থকরা যখন স্বয়ং ধোনির মুখেই শুনলেন আরও একটি মৌসুম খেলার সম্ভাবনার কথা, তখন তো তাদের আনন্দের আর সীমা থাকার কথা নয়।
আইপিএলের পঞ্চম ট্রফিটা তুলে ধরে ধোনি অবসরের ঘোষণা দেবেন- যে কারণে দলের ক্রিকেটাররা প্রস্তুত ছিলেন যেন তাকে কাঁধে তুলে, শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে উল্লাস-উদযাপন করার জন্য; কিন্তু ধোনি যেন বরাবরই বাকিদের চেয়ে আলাদা। আবেগে ভেসে, সতীর্থদের কাঁধে চেপে মাঠ ঘুরে বিদায় নেওয়ার পাত্র নন তিনি। তাই পঞ্চম আইপিএল ট্রফি জিতেও অবসর ঘোষণা করলেন না তিনি। জানিয়ে দিলেন, সম্ভব হলে আরও এক বছর পরে ফিরে আসতে চান।
ট্রফি হাতে তোলার আগেই সঞ্চালক হার্সা ভোগলের প্রশ্নের মুখোমুখি হন ধোনি। সরাসরি অবসর নিয়ে প্রশ্ন না করলেও, হার্সার ইঙ্গিত ছিল সে দিকেই। হাসতে হাসতে ধোনির উত্তর, ‘তুমি তাহলে একটা উত্তর খুঁজছ তাই তো? হ্যাঁ, হয়তো অবসর ঘোষণা করার এটাই সেরা সময়। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে গোটা দেশে যে ভালবাসা পেয়েছি সেটা কোনও দিনই ভোলার হয়। এখান থেকে ক্রিকেটকে পাকাপাকিভাবে বিদায় জানাতেই পারি; কিন্তু আমার কাছে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ হল, পরের নয় মাসে কঠোর পরিশ্রম করে এবং আরও একটা আইপিএল খেলার চেষ্টা করা। এখনও আমার কাছে ভাবার জন্য ৬-৭ মাস রয়েছে। আমার পক্ষ থেকে এটা সমর্থকদের কাছে উপহার। জানি, শরীরের জন্য কাজটা সহজ হবে না। তবুও…।’
ধোনির কথা সত্য। এবার আইপিএলে পুরো ভারত ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। যখন যে স্টেডিয়ামে গেছেন, সেখানেই ধোনির নামে রব উঠেছে। দর্শকরা মিছিল করেছে। তাকে দেখে করতালিতে ভরিয়ে তুলেছে। অন্য দলের সমর্থক হলেও শুধু ধোনির নামাঙ্কিত জার্সি পরে ক্রিকেটভক্তরা মাঠে চলে এসেছে। তার প্রতি ভক্তদের ভালবাসার এ দৃশ্য দেখে যে কারো অভিভূত হয়ে যাওয়ার কথা।
ধোনি মেনে নিয়েছেন, যে ভালবাসা তিনি পেয়েছেন তা কোনও দিন ভুলতে পারবেন না। মাথা ঠান্ডা রাখলেও তিনি রক্তমাংসের মানুষ। ধোনি বলেন, ‘এ ভালবাসাতে আপনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বেনই। চেন্নাইয়ের হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামার সময় পুরো স্টেডিয়াম আমার নাম ধরে চিৎকার করছিল। তখন সত্যি আমার চোখ পুরো পানিতে ভরে গিয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য ডাগআউটে চুপচাপ বসেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, আমাকে এটা উপভোগ করতে হবে। আসলে ওরা আমি যেমন, তেমনভাবেই আমাকে ভালবাসে। আমি এমন কিছু কখনও দেখাতে যাই না যেটা আমি নই। সবকিছু সহজ রাখার চেষ্টা করি।’
আগে চারটি আইপিএল ট্রফি জিতলেও পঞ্চম ট্রফি নিয়ে আলাদা ভালবাসা রয়েছে ধোনির। সে প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমার কাছে সব ট্রফিই বিশেষ অনুভূতির; কিন্তু আইপিএলের বিশেষত্ব হল, প্রতিটা ম্যাচই টানটান উত্তেজনার। আপনাকে সব সময় তৈরি থাকতে হবে। আজ (সোমবার রাতে) আমাদের খেলায় অনেক ভুল হয়েছে। বোলিং বিভাগ ঠিকঠাক নিজেদের কাজ করতে পারেনি। কিন্তু ব্যাটিং বিভাগ সব চাপ কাটিয়ে আমাদের জয় এনে দিয়েছে।’
দলের ক্রিকেটারদের সম্পর্কেও অগাধ আস্থা রয়েছে ধোনির। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও হতাশ হয়ে পড়ি। আমি তো একটা মানুষ। কিন্তু প্রত্যেকের কাছে চাপ সামলানোর আলাদা আলাদা উপায় রয়েছে। আমার দলে আজিঙ্কার মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটার আছে। তাই চিন্তার কোনও কারণ নেই। আমার দলে কারও কোনও ব্যাপারে দ্বিধা থাকলে, সে অনায়াসে প্রশ্ন করতে পারে। সে দরজা সব সময় খোলা আছে।’
সোমবারই শেষ ম্যাচ খেলে ফেললেন আম্বাতি রাইডু। সতীর্থকে নিয়ে ধোনি বলেন, ‘রাইডুর অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হল, সে মাঠে থাকলে সব সময় নিজের ১০০ শতাংশ দেবে; কিন্তু সে দলে থাকলে আমরা কোনও দিন ফেয়ার প্লে পুরস্কার জিততে পারব না। অনেক দিন ধরে রাইডুর সঙ্গে খেলছি। সে ভারত ‘এ’ সফরের সময় থেকে। এমন ক্রিকেটার যে পেস এবং স্পিন সমান ভাবে খেলতে পারে। এটা সত্যিই একটা বিশেষ গুণ। আমার আগেই মনে হয়েছিল সে আজকের ম্যাচে কিছু একটা করবে। আসলে সেও আমার মতো। খুব একটা ফোন ব্যবহার করে না। আশা করি জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে ও ভালভাবেই উপভোগ করবে।’
আইএইচএস/